সিরাজী এম আর মোস্তাকঃ জাতীয় শোকের মাসে বাঙ্গালি জাতির জনকের ঘোষণা ও আমাদের অবস্থান বর্ণনা করছি। ১০ জানুয়ারী ১৯৭২, বঙ্গপিতা দেশে ফিরে লাখো জনাতার সামনে ঘোষণা করেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি নাগরিক সবাই মুক্তিযোদ্ধা। আপনারা ত্রিশ লাখ প্রাণ বিসর্জন করেছেন এবং দুই লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু কবিগুরুকেও চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, ‘কবিগুরু দেখেন তারা শুধু বাঙ্গালি নয়, মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীন জাতি।’ বঙ্গবন্ধুর দেয়া সে স্বীকৃতি আমরা হারিয়ে ফেলেছি। শত সংগ্রাম ও প্রাণ বিসর্জনের মাধ্যমে ঘাতক পাকিস্তানি বাহিনী থেকে মুক্তি লাভ করেও পৃথিবীতে আমরাই যুদ্ধাপরাধী জাতি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশীদেরকে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরোধী অপরাধী হিসেবে সাজা দেয়া হচ্ছে। ঘাতক পাকিস্তানিরা ধোয়া তুলসি পাতা। তারা যুদ্ধাপরাধী নয়। অর্থাৎ বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীরাই ত্রিশ লাখ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে এবং দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জত হরণ করেছে। কী আজব ইতিহাস! আমাদের ভাব-মর্যাদা কোন দিকে যাচ্ছে?
একইভাবে বাংলাদেশে এখন জঙ্গিবিরোধী অভিযান ও সমাবেশ হচ্ছে। পৃথিবীর মানুষ দেখছে, জঙ্গি-সন্ত্রাসের বিরূদ্ধে আমাদের মহা অর্জন। আসলে কি তাই? পুলিশী রিমান্ডে থাকা জঙ্গি ফাহিমকে হাতকড়া অবস্থায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে হত্যা করা হয়েছে। শোলাকিয়ার ঘটনায় অভিযুক্ত শফিকুল গাইবান্ধা জেলার গোবিন্দগঞ্জ থেকে আটকের প্রায় বিশদিন পর সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয়েছে। ঝিনাইদহ ও দেশের বিভিন্ন স্থানে মেধাবী যুবকদেরকে আটকের পর কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এভাবে কথিত জঙ্গিরা পুলিশের জিম্মায় থাকার পরও সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হচ্ছে, এতে কি আদৌ জঙ্গি দমন হচ্ছে? কথিত মাত্র ছয়জন জঙ্গি গুলশান হামলায় দুইজন দক্ষ পুলিশ অফিসারসহ বাইশজনকে হত্যা করেছে। আমাদের হাজার হাজার দক্ষ পুলিশ সারারাতেও তাদের নাগাল পায়নি। অথচ এর চেয়ে কম পুলিশ নিমিষেই কল্যাণপুরের মেস থেকে কথিত নয়জন দুর্ধর্ষ জঙ্গিকে হত্যা করতে সমর্থ হয়েছে। এরপর জঙ্গিদের কথিত আখঁড়া নির্মূলে চলছে বিশেষ অভিযান ও র্যালী-সমাবেশ। প্রতিদিন জঙ্গি আটকের সংবাদ পরিবেশন হচ্ছে। এতে পৃথিবীতে বাংলাদেশের ভাব-মর্যাদা বাড়ছে নাকি কমছে?
মূলত ঘাতক পাকিস্তানিদের পরিবর্তে আমরাই কি যুদ্ধাপরাধী? কাদের চক্রান্তে আমাদের এ মানহানি? আমরা কেন লান্থণার দিকে যাচ্ছি? আমরা কি আত্মত্যাগী ও বীরের জাতি নই? আমরা কি স্বাধীনতার জন্য লড়াই করিনি? আমাদের ত্রিশ লাখ শহীদ কি প্রাণ হারায়নি? তাহলে আমরা কেন যুদ্ধাপরাধী জাতি? একইভাবে, আমরা কেন জঙ্গি হবো? আমরা কি স্বাধীনতা হারিয়েছি? মূলত কারা আমাদেরকে জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?
মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত চেতনা ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ফলেই আমরা যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গিজাতি বিবেচিত হয়েছি। আমরা কি কখনো এ লান্থণা ঘুচাতে পারবো? তাই, জঙ্গি হামলার নামে দেশের ভাবমুর্তি নষ্ট করা উচিত নয়। বাংলাদেশীদের বিরূদ্ধে প্রচলিত যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রযোজ্য নয়। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংশোধন করা উচিত। শুধু দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা বা কোটা নয়; বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চার নেতা, এমএজি ওসমানীসহ যোদ্ধা ও শহীদ মিলে ১৯৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকেই মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দেয়া উচিত। বাংলাদেশের ষোল কোটি নাগরিক সবাই উক্ত পরিবারের সদস্য। তারা যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গি নয়, সংগ্রামী বীর ও মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম।